প্রত্যয় নিউজ ডেস্ক : শেষ পর্যন্ত বিশ্ব দুটি কোভিড-১৯ টিকা পাচ্ছে, যেগুলোকে খুবই কার্যকর বলা হচ্ছে। এখন কথা হলো এসব টিকা বাংলাদেশের জনগণ কি তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী দ্রুত পাবে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে এ ক্ষেত্রে রয়েছে বাধা!
ফাইজার-বায়োএনটেক এবং মডার্নার কোভিড-১৯ টিকার পরীক্ষা থেকে পাওয়া অত্যাশ্চর্য ফলাফল প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশ্বব্যাপী আশা জাগিয়ে তুলেছে। কিন্তু টিকা দুটি সংরক্ষণ করার জন্য যে কোল্ড চেইন (শীতল ব্যবস্থা) দরকার তার অভাবকে বাংলাদেশের সুফল পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, মর্ডানা ও ফাইজার যে এমআরএনএ প্রযুক্তি ভিত্তিক টিকা তৈরি করেছে তা সংরক্ষণ করতে হবে মাইনাস ৭০-৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। কিন্তু বাংলাদেশে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) আওতায় জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ও শিশুদের টিকা সংরক্ষণ ও বিতরণের জন্য যে ব্যবস্থা আছে তার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা হলো মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, এমআরএনএ টিকা সংরক্ষণ, পরিবহন ও বিতরণের জন্য নিজেদের সক্ষমতা বাংলাদেশের রাতারাতি অর্জন করার সম্ভাবনা কম। কারণ এটি খুবই ব্যয়বহুল এবং সময় সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। আর এ জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক রেফ্রিজারেটর স্বল্প সময়ে পাওয়া যাবে না।
এমন পরিস্থিতিতে তারা বলছেন, বাংলাদেশের একটি বিচক্ষণ কোভিড-১৯ টিকা নীতি দরকার। পাশাপাশি অন্য যেসব সম্ভাব্য দেশ ও সংস্থা টিকা তৈরির জন্য তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা চালাচ্ছে তাদের সবার সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে। যাতে বিদ্যমান শীতল ব্যবস্থা ব্যবহার করে ক্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণ করার মতো উপযুক্ত টিকা পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ইউএনবিকে বলেন, ‘প্রথম যে উৎস থেকে পাব সেখান থেকে আমরা উপযুক্ত টিকা সংগ্রহ করব। এ জন্য আমরা সবার সাথে যোগাযোগ করছি।’
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তুতকৃত টিকার তিন কোটি ডোজ পাওয়ার জন্য সরকার সম্প্রতি সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া (এসআইআই) এবং বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে বলে জানান তিনি।
মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এ টিকাটি প্রাথমিক পর্যায়ে পেয়ে যাব এবং এটি বেক্সিমকোর কোল্ড স্টোরেজে সংরক্ষণ করা হবে। আমরা দেশের দেড় কোটি মানুষকে এ টিকা দিতে সক্ষম হব… প্রতি ব্যক্তির জন্য দুটি ডোজ।’
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আবদুল মান্নান বলেছেন, সরকার ফাইজার ও মডার্নার টিকা সংগ্রহের কথা ভাবছে না কারণ সেগুলো তাপমাত্রাজনিত সমস্যার কারণে বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত নয়।
তিনি বলেন, ‘বিশ্বের নয়টি সংস্থা কোভিড টিকা তৈরির চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে এবং আমরা তাদের মধ্যে ছয়টির সাথে যোগাযোগ করছি। আমরা যেকোনো উপযুক্ত ভ্যাকসিন কিনব সেটি আগে পাওয়া যাবে।’
এমআরএনএ টিকা সংরক্ষণের অসুবিধা
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রাক্তন পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. বে-নজির আহমেদ জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ (ডব্লিউএইচও) অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন পেলে দুটি এমআরএনএ প্রযুক্তি ভিত্তিক করোনা টিকা শিগগিরই বাজারে আসতে পারে।
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ আগামী ছয় মাসের মধ্যে এ টিকাগুলো পেতে পারে। তবে বিভিন্ন কারণে এ দুটি টিকা সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করা বাংলাদেশের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়বে। টিকা দুটির সংরক্ষণে তাপমাত্রা প্রয়োজন মাইনাস ৭০-৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।’
এছাড়া, প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা বজায় রেখে এ টিকাগুলো পরিবহন করতে পারবে এমন বিমানের সংখ্যাও খুব কম বলে জানান এ বিশেষজ্ঞ।
তিনি বলেন, ‘প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র থেকে এ টিকাগুলো ঢাকায় আনতে অসুবিধা হবে। দ্বিতীয়ত, আমরা যদি টিকাগুলো বহন করতে পারে এমন বিমান পরিচালনা করতে পারিও, তবু বিমানবন্দর থেকে এগুলো বহন করার মতো প্রয়োজনীয় পরিবহন ব্যবস্থা আমাদের নেই। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এ টিকাগুলো সংরক্ষণ, পরিবহন এবং বিতরণের জন্য আমাদের কোল্ড চেইন ব্যবস্থা নেই।’
ডা. বে-নজির বলেন, বাংলাদেশের এখন সেসব টিকার প্রতি মনোনিবেশ করা উচিত যেগুলো বিদ্যমান কোল্ড চেইন ব্যবস্থা ব্যবহার করে সংরক্ষণ করা যেতে পারে।
কারা টিকা প্রথমে পেতে পারেন?
সরকার কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত এ বিশেষজ্ঞ বলেন, টিকাগুলো একবার হাতে পাওয়া গেলে এর ডোজ বিতরণের জন্য ইতোমধ্যে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করেছে ভ্যাকসিন বিষয়ক বিশেষ কমিটি (নাইট্যাগ)।
ডা. বে-নজির বলেন, নাইট্যাগের রূপরেখা অনুসারে স্বাস্থ্যকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ করোনা মহামারি মোকাবিলায় যারা ফ্রন্টলাইনে কাজ করছেন তারাই প্রথম অগ্রাধিকার পাবেন।
এছাড়া, নাইট্যাগ প্রথম পর্যায়ে গণমাধ্যম কর্মী, প্রবীণ জনপ্রতিনিধি এবং প্রবীণ বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরও এ টিকা সরবরাহ করার পরামর্শ দিয়েছে বলে জানান ডা. বে-নজির।
একাধিক জটিল রোগে আক্রান্ত এবং প্রবীণ নাগরিকদেরও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ টিকা দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তবে প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা গর্ভবতী নারী ও শিশুদের টিকা দেয়ার পরামর্শ দেইনি কারণ তাদের ওপর প্রতিক্রিয়া কেমন হবে তা মূল্যায়ন করার জন্য আমাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য কোনো গবেষণা নেই।’
ডা. বে-নজির বলেন, নাইট্যাগ বিনামূল্যে টিকা সরবরাহের সুপারিশ করেছে, তবে সরকার টিকার প্রতিটি ডোজের জন্য ৪-৫ ডলার সমতুল্য অর্থ নিতে চায়।
জরুরিভাবে টিকা নীতিমালা দরকার
প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশ পর্যাপ্ত পরিমাণ টিকা নাও পেতে পারে উল্লেখ করে ডা. বে-নজির বলেন, ‘এ মহামারি নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা যা পাই তা সফলভাবে ব্যবহার করার জন্য যথাযথ পরিকল্পনা করা প্রয়োজন।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা ডা. মুজাহেরুল হক বলেন, কার্যকর টিকা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিতরণের জন্য সরকারের খুব শিগগিরই একটি জাতীয় কোভিড টিকা নীতিমালা তৈরি করা উচিত।
তিনি আরও বলেন, ‘দেশের মানুষের মধ্যে সংক্রমণের মাত্রা এবং তাদের শরীরে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য জানতে আমাদের জাতীয় পর্যায়ের একটি জরিপ প্রয়োজন এবং মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিশ্লেষণের জন্য আমাদের র্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট করা প্রয়োজন। এটি টিকার প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডোজ সম্পর্কে ধারণা পেতে এবং এর ন্যায়সঙ্গত বিতরণের জন্য অগ্রাধিকার নির্ধারণে সহায়তা করবে।’
দক্ষতা ও সুরক্ষার স্তর, প্রাপ্যতা এবং সাশ্রয়ী…এ ধরনের কিছু নীতির ওপর ভিত্তি করে সরকারকে একটি কার্যকর টিকা সংগ্রহ করতে হবে উল্লেখ করে ডা. মুজাহের বলেন, ‘টিকার জন্য কোনো চুক্তিতে স্বাক্ষর করার আগে আমাদের এসব বিষয় বিবেচনা করতে হবে।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশের এমন কোনো টিকা সংগ্রহ করা উচিত হবে না যার মূল্য, সংরক্ষণ এবং বিতরণের বিষয়টি সরকার বহন করতে পারবে না।
এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, বিপণনের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বা দেশের টিকা ডব্লিউএইচও এবং অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন না পাওয়া পর্যন্ত তাদের সাথে বাংলাদেশের কোনো চুক্তি করা উচিত হবে না।
‘টিকা প্রস্তুতকারক সব দেশ এবং সংস্থার সাথে আমাদের যোগাযোগ রাখা উচিত, তবে তাড়াহুড়া করে আমাদের কোনো চুক্তি করা উচিত নয়। দেশের জন্য উপযুক্ত টিকা খুঁজে বের করতে সরকারের উচিত ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে (ডিজিডিএ) কর্তৃত্ব দেয়া,’ পরামর্শ দেন মুজাহেরুল হক।